৫ই আগস্ট, ২০২৪ সোমবার লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন
৪ আগষ্ট রোববার সকালে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে তিন বাহিনীর প্রধান, ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা ও পুলিশ কর্মকর্তারা অংশ নিয়েছিলেন। বৈঠকের পরিবেশ ছিল গম্ভীর। দেশজুড়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর কয়েক সপ্তাহ ধরেই চাপ বাড়ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ এই সহিংসতায় কয়েক শ মানুষ নিহত হন। শুধু রোববার এক দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১১০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বিক্ষোভকারী ছাত্র-জনতা। তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান। তবে বিক্ষোভের সময় ছাত্র-জনতার হাতেও বেশকিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও নিহত হয়েছেন। রবিবার সারাদেশে অনিদিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয় এবং দেশ জুড়ে ইন্টারনেট এবং সোস্যাল মিডিয়া একাউন্টস ( ফেসবুক, টিকটক, টেলিগ্রাম, ইউটিউব) বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই কারফিউ ছাত্র-জনতা প্রত্যাখ্যান করে এবং আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে।
পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার পর জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। একাধিক সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, আলাদাভাবে বৈঠকে সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, সেনারা বেসামরিক লোকজনের ওপর গুলি চালাবেন না। তবে তাঁরা পুলিশকে নিরাপত্তা সহায়তা দিতে পারবেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, তাঁদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। যদিও এ বিষয় পরে প্রকাশ পায়। শেষ মুহুর্তে রবিবারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠন দলিয় ক্যাডার বাহিনী ছাত্র-জনতার উপর দেশিও অস্ত্র এবং বন্দুক দিয়ে হামলা চালায়। এতে করে বিভিন্ন জেলায় গুলিতে আহত এবং নিহত তরুণদের ছবি আরও ক্ষোভের জন্ম দেয়। রোববার দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঠপর্যায়ের সেনা ও সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ ও আন্দোলনকারীরা।
নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা আশঙ্কা করেন সোমবার সকালে ঢাকায় লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম ঘটতে পারে। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, রোববার সন্ধ্যায় তিন বাহিনীর প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা বিনয়ের সঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলেন, মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। তাঁরা গণভবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না। শেখ হাসিনা তারপরও তিন বাহিনীর প্রধানের পরামর্শ গ্রহণ করেননি। রোববার রাত নাগাদ অনেক জায়গায় পুলিশের উপস্থিতি ছিল না। অসংখ্য নিরাপত্তা ব্যারিকেড ছিল খালি। তিন বাহিনীর প্রধান তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁকে মাঠপর্যায়ে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। নিরাপত্তা বাহিনী আশঙ্কা করেছিল, তাদের হাত ধরে শিগগিরই দেশে গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি আসতে পারে। রোববারের সহিংসতার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে (ভাইরাল) পড়ছিল। কারণ, মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছিল। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের সংঘর্ষের ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়ে উঠলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা ঢাকামুখী গণমিছিলের কর্মসূচি এক দিন এগিয়ে আনার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণায় কর্তৃপক্ষ বিস্মিত হয়ে যায়। ছাত্রদের দাবি তখন মানুষকে আকৃষ্ট করে ফেলে।
পরের দিন সোমবার ৫ই আগস্ট সকাল থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছাত্র-জনতা কারফিউ ভেঙে রাজধানীমুখী হতে শুরু করেন, ঢাকা অভিমুখে বিপুল জনতার পদযাত্রা শুরু হয়। এই দিন ঢাকার শাহবাগ, রামপুরা, উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানের রাজপথে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামে। বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্তে আরো বেশি বল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন এরজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আরো কঠোর হতে বলেন, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরাও জানান যে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রনের বাহিরে । শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের আরো বেশি কঠোর হতে বললে তারাও শেখ হাসিনার কথায় রাজি হননি। নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের থামানোর চেষ্টা করলে আরেকটি রক্তপাত ঘটবে। তাই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আবারও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গণভবনে গিয়ে তাঁকে পরিস্থিতির গভীরতা ব্যাখ্যা করছিলেন। লোকজন কারফিউ ভঙ্গ করছিল। ইতিমধ্যে সহিংসতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঢাকার অনেক জায়গা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করা হচ্ছিল।
এই পর্যায়ে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং সামরিক প্রধানেরা শেখ হাসিনাকে বোঝানোর জন্য তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর প্রধানেরা তখন শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার সঙ্গে কথা বলেন। শেখ রেহানাকে তাঁর বড় বোনকে পদত্যাগ করাতে পারেন কি না, সে কথা বলেন তাঁরা। কর্মকর্তারা শেখ রেহানার সঙ্গে অন্য একটি কক্ষে আলোচনা করেছিলেন। তাঁরা তাঁকে শেখ হাসিনার কাছে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন। শেখ রেহানা তখন তাঁর বড় বোনের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখতে অনড় ছিলেন। তারপর বিদেশে থাকা শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ ফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা তাঁকে চলে যেতে বলেন।
এরপর তিনি পদত্যাগ করেন এবং দেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। এইসময় তিনি একটি ভিডিও বার্তা রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটার আর সুযোগ থাকে না, কারণ এরমধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আসে যে শাহবাগ এবং উত্তরা থেকে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, তাঁরা খুব বেশি সময় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে জনতার পৌঁছানো ঠেকাতে পারবেন না। সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট বা তার কিছু বেশি সময় তা সম্ভব হতে পারে, ভিডিও রেকর্ড করতে গেলে সময় নষ্ট হলে পরে আরো খারাপ কিছু ঘটতে পারে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা তাঁর পদত্যাগের নথিতে স্বাক্ষর করেন এবং নিরাপদে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এইসময় শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা একটি সামরিক হেলিকপ্টারের মাধ্যমে গণভবন ছেড়ে পালিয়ে যান। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, একটি সামরিক হেলিকপ্টারের মাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রথমে বিমানবন্দরে পৌঁছায় , এরপর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি একটি অপেক্ষমাণ সি-১৩০ হারকিউলিসে ওঠেন। এই সামরিক উড়োজাহাজের মাধ্যমে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বাংলাদেশ সময় সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় কর্তৃপক্ষ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, ১দিন আগে থেকেই মোবাইল ডাটা এবং সকল প্রকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়। যাতে শেখ হাসিনার গতিবিধির কোনো খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে না পড়ে। তিনি পালিয়ে যাওয়ার কিছুসময় পরেই ইন্টারনেট আবার চালু করা হয়েছিল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, চার বা পাঁচটি স্যুটকেস অপেক্ষমাণ উড়োজাহাজ বা হেলিকপ্টারে ওঠানোর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। তিনি যেসব জিনিস রেখে গিয়েছিলেন, তার অনেক কিছু তাঁর বাসভবনে হামলা চালিয়ে নিয়ে যায় জনগণ। এমনকি গণভবনে ছাত্র-জনতার বিজয় উল্লাসের সময় তিনি মাঝ–আকাশেই ছিলেন। কয়েক ঘণ্টা পরে উড়োজাহাজটি ভারতের দিল্লিতে অবতরণ করে। উড়োজাহাজটির যাত্রীদের গন্তব্য ছিল অস্পষ্ট। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের সমাপ্তি উপলক্ষে সারা বাংলাদেশজুড়ে তখন বিজয় উদ্যাপন শুরু হয়েছিল।
একজন নারী, যাঁকে একসময় গণতন্ত্রী হিসেবে মনে করা হতো, ক্ষমতা গ্রহনের পর তিনি ক্রমেই স্বৈরাচারী হিসেবে অনেকের কাছে নিন্দিত হন। ইন্টারনেট বন্ধ রেখে তাঁকে শেষ পর্যন্ত একজন পলাতক ব্যক্তির মতো দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হলো।
শেখ হাসিনার পতনের পর গণভবন, সংসদ ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের যে অবস্থা ছিল
শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবরটি যখন সারাদেশে ছড়িয়ে পরে, তখনও রাস্তায় ছিল লাখো মানুষ। মিছিল নিয়ে তাদের অনেকেই ছুটতে থাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সরকারি বাসভবন গণভবনের দিকে। নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে বেলা তিনটার দিকে গণভবনে ঢুকে পড়েন লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতা। গণভবনের ভেতরে হাজার হাজার জনগণ প্রবেশ করে উল্লাস করতে থাকে, এসময় গণভবণ থেকে চেয়ার-টেবিলসহ বেশকিছু জিনিসপত্র নিয়ে বের হতেও দেখা গেছে বেশ কয়েকজনকে। আবার অনেকের হাতে গণভবনের হাস, মুরগী, কবুতর, পুকুরের মাছ নিতেও দেখা যায়। কাওকে দেকা যায় গণভবনের খাবার খেতে। ২০২২ সালে শ্রিলঙ্কার গণঅভ্যুত্থানের ফলে শ্রিলঙ্কার জনগণ যেমন সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে প্রবেশ করে উৎযাপন করতে থাকে ঠিক তেমই চিত্র এদিন বাংলাদেশে দেখা যায়। অনেককে সে সময় গণভবনের ভেতরেই বিজয় মিছিল করতে দেখা যায়।
বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে হঠাৎই তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পিজিআরসহ সব বাহিনী একে একে কার্যালয় ছাড়তে থাকে। সাধারণ মানুষের জন্য তারা এই কার্যালয়ের গেট পুরোপুরি খুলে দিলে ঢল নামে হাজারো মানুষের। কার্যালয়ের ছাদে পতাকা তুলে বিজয় উল্লাস মত্ত হন অনেকে। সেখানে ছাত্র ছিল, শিশু, বৃদ্ধা কিংবা যুবক। বহু মানুষ এখানে এসে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছে অনেকে তাদের আক্ষেপের কথা বলেন। কেউ কেউ বলছিলেন, গত ১৫ বছরে মানুষ ভোট, মত প্রদানের অধিকারসহ বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক সাধারণ মানুষ মারা গেছেন। সে সব ক্ষোভের কথাও জানান অনেকে।
বিকেল থেকে অনেক মানুষকে গণভবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসতে দেখা গেছে। যে যা পারছেন, সেটাই সঙ্গে নিয়ে যান। টেলিভিশন, ফ্রিজ, শাড়ি, সোফা, এসি, মাছ, ফ্যান, হাঁস, মিষ্টি, ফুলের টব কোনো কিছুই বাদ যায়নি। গণভবনের ভেতরে ও বাইরে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। তছনছ করে ফেলা হয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন। কোথাও কোথাও ধোঁয়ার কুণ্ডলীও দেখা গেছে। গণভবনের মাঠে উল্লাস করতে দেখা গেছে অনেককে। মোবাইল ফোনে সেলফি তুলছিলেন, আবার কেউ কেউ ভিডিও করছিলেন সার্বিক চিত্র। গণভবনের সামনের রাস্তায় দেখা গেছে, ভেতর থেকে নিয়ে আসা সোফায় বসে আছেন অনেকে। কেউ রিকশায় চড়ে আবার কেউ মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছেন গণভবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র। সন্ধ্যার দিকেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। গণভবন থেকে বেরিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের প্রাঙ্গণেও ছিল জনতার ঢল। এখানেও হাজার হাজার জনতা প্রবেশ করে এবং সংসদ ভবনের মধ্যে বিভিন্ন আসনে ভাংচুর করে উল্লাস করা হয়।
কারও মাথায় সোফা, কারও মাথায় গদি, কেউবা নিয়ে যাচ্ছেন প্লাস্টিকের চেয়ার। এত এত চেয়ার, সোফা—এর সবই সংসদ ভবন আর গণভবনের। কেউ নিয়েছেন রেজিস্টার, কেউ শাক, কেউ মাছ, হাঁস, ছাগল, গাছ, ফুল, গাছের ডাল, পাতা ও মূর্তি। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ফ্যান, এসি, লেপ, কাঁথা, কম্বল, শাল, চাদর, পেইন্টিং, শতরঞ্জি, পাপোশ, বালতি, বদনা, ট্রফি, কাগজপত্র, ফাইল, শোপিস, তৈজসপত্র, কুশন, ফুলের টব, গাছ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি, হাঁস, বাল্ব, মাছ—কী নেই যা নিয়ে যাচ্ছেন না মানুষ! অনেকেই বড় বড় বাক্স মাথায় নিয়ে হাঁটছেন। সেসব বাক্সভর্তি শাড়ি! সংসদ ভবন এলাকায় সোফার ওপর রাজকীয় কায়দায় বসে ছবিও তুলেছেন অনেকে। কয়েকজন মিলে ফ্রিজ টেনে বেশি দূর নিয়ে যেতে না পেরে হতাশ হয়ে বাইরে ফেলে রেখে গেছেন। ফ্রিজের ভেতরের খাবার আর যন্ত্রাংশ খুলে নিয়ে গেছেন। অনেকে শাড়ি ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। প্লেট, বাসনকোসন, আসবাব আর গাছ যাঁরা নিয়ে যাচ্ছিলেন, আশপাশের মানুষ চাইলে তাঁদেরও দিয়েছেন। বিকেল পাঁচটায় গণভবনের পুকুরে অনেকে মাছ ধরছিলেন। অনেকেই বলতে শোনা গেছে, ‘আপা, ফুলকপি গণভবনের’ ‘লাউ, মিষ্টিকুমড়া কি গণভবনের। যাঁরা এসব নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের দেখে অনেকেই বলছেন, ‘জনগণের মাল জনগণ নিয়ে যাচ্ছেন।
**শেখ হাসিনার পতন: একটি সম্ভাব্য রাজনৈতিক দৃশ্যপট**
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘকাল ধরে শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তবে প্রতিটি শাসনের প্রথম থেকেই রাজনৈতিক এবং সামাজিক চাপ তৈরি হয়েছিল যা তার ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে সবসময় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা গিয়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতা থাকা কালে দেশে তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশের জনগণ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এই নির্বাচনগুলিতে কখনই ভোট দেওয়ার সুযোগ পায় না। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বরাবরই এই নির্বাচনগুলি প্রত্যাক্ষান করেন। যার ফলে দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতন্ত্রের সংকট দেখা দেয়। দেশের বেশির ভাগ জনগণ এসমস্থ কারণে সরকারের উপর ক্ষুব্ধ থাকে।
**রাজনৈতিক পটভূমি:**
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছর ধরে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, গণতন্ত্রের সংকট, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠেছিল। এছাড়া, বিরোধী দল বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো বহুবার অভিযোগ করেছে যে, তাদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। বিরোধী দলগুলোর ক্রমবর্ধমান চাপ বিএনপি, জামায়েত ইসলামি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময়ে সংঘবদ্ধ হয়ে সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন গড়ে তুলে ছিল। তবে সরকারের অতিমাত্রায় দমন, পিড়ন, গ্রেফতার, খুন এবং গুমের কারণে বেশির ভাগ আন্দোলন সফলতা পায়নি। সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে আওয়ামী লীগের শাসনের সময়ে গণতন্ত্রের সংকট নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে করে দেশের ভেতরে ও বাইরে সরকারের জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারী এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ অস্থিরতা দেখা দেয়। বহু সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংক দেওলিয়া হয়ে যায়। মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, এবং দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি, দ্রব্যমূলের উদ্ধগতির ফলে এবং সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সীমাহীন দুর্নিতীর কারণে সাধারণ জনগণের মধ্যে বহু বছর ধরে অসন্তোষ বেড়ে যায়।
শেখ হাসিনার পতনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে। আবারও বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে। বিশেষ করে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল করা, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা। শেখ হাসিনার পতন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। বাংলাদেশের জনগণের আশা থাকবে যে, যেই ক্ষমতায় আসুক, তারা দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হবে।
তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যম থেকে সংগৃহিত