টাইটানিক এক শতাব্দীর রহস্য
আরএমএস টাইটানিক, যা ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত জাহাজ, এটি ছিল একটি বিলাসবহুল ব্রিটিশ যাত্রীবাহী জাহাজ। এটি ১৫ এপ্রিল ১৯১২ সালে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে একটি আইসবার্গের সাথে সংঘর্ষে ডুবে যায়, যা ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক সামুদ্রিক দুর্ঘটনাগুলির মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। টাইটান নামটি ছিল গ্রিক পুরানের কথিত শক্তিশালী দেবতা। সেই নামানুসারেই এই জাহাজের নামকরণ করা হয়। পুরা নাম ছিল আর এম এস টাইটানিক। এটার অর্থ হলো রয়্যাল মেল স্টিমার। সম্পূর্ন জাহাজটির নাম ছিল ” রয়্যাল মেল স্টিমার টাইটানিক”। ১৯০৭ সালে টাইটানিকের কাজ শুরু হয়। নির্মান কাজ শেষ হয় ১৯১২ সালে। ইংল্যান্ডের “হোয়াইট স্টার লাইন” জাহাজটি নির্মান করে। ৬০ হাজার টন ওজন & ২৭৫ মিটার দেঘ্য বিশিষ্ট জাহাজটি সেসময় খরচ ছিল ৭৫ লাখ ডলার।
টাইটানিক জাহাজ, ১৫ এপ্রিল ১৯১২ সালে তার ১ম ভ্রমনেই সাউথহ্যাম্পটন থেকে নিউইয়র্কে সিটিতে যাওয়ার পথে আইসবার্গের সাথে সংঘর্ষ হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরেই ডুবে গিয়েছিল। বিপদের সংকেত টাইটানিক জাহাজের ক্যাপ্টেন এডওর্যাড জন স্মিথ বুঝতে পারলে জাহাজের দিক সরাতে সংকেত দিলেও ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে যায়। বিপদ যা হবার সেটা হয়ে যায়। টাইটানিক জাহাজ যে স্থানে ডুবেছিল সেই জায়গার নাম “গ্রেট ব্যাংকস অফ নিউফাউন্ডল্যান্ড”।
টাইটানিক সর্বোচ্চ ৪ টি কম্পাটমেন্ট নিয়ে ভেসে থাকতে পারলেও ৬ টি কম্পাটমেন্টই ভেসে গিয়েছিল। এছাড়া পানি প্রতিরোধে ১২ টি গেট থাকলেও দুভাগ্যবশত ভাবে এমন জায়গায় ধাক্কা লাগে যে ১২ টি গেটই বিকল হয়ে যায়। পানির ভারেই আস্তে আস্তে ডুবে যায় টাইটানিক জাহাজ। রাত ২ টা ২০ মিনিট নাগাদ সম্পুর্ন টাইটানিক জাহাজ আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সম্পুর্ন ডুবে যায়। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট পর ৪ টা ১০ মিনিয়ে সেখানে আসে ” দি কারপাথিয়া” নামক একটা জাহাজ। জাহাজটি সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়ানো ৭০০ জন যাত্রী উদ্দ্বার করে নিউইয়র্কে নিয়ে যান সকাল ৮ দিকে। জাহাজে যাত্রী সংখ্যা ছিল ২২২৪ জন। ১৫০০ বেশি যাত্রী মারা যায়।
দীর্ঘ ৭৩ বছর পর ১৯৮৫ সালে যন্ত্রচালিত অনুসন্ধান শুরু করে একদল বিজ্ঞানী। রর্বাট বার্লাড নামে ফরাসী বিজ্ঞানী টাইটানিক জাহাজ খুজে পান। টাইটানিক জাহাজ সমুদ্রপৃষ্ঠের ১২ হাজার ৬০০ ফুট নিচে আটলান্টিকের তলদেশে স্থির হয়ে রয়েছে। জাহাজের ২ টুকরা ১৯৭০ ফুট দূরে অবস্থান করছে। জাহাজের সম্মুখ ভাগ সমুদ্রতলে ৬০ ফুট মাটির তলে পতিত হয়ে গেছে।
১৮ জুলাই, ১৯৮৬ সালে ৭৪ বছর পর টাইটানিক জাহাজ আবারো পুনরাবিষ্কার হয়। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার শুরু হয়। কিন্তু ২০ জুন,২৩ সালে ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাওয়া টাইটান সাবমেরিন ও উধাও হয়ে যায়। ৫ জন যাত্রী নিহত হন।
নির্মাণ ও নকশা
টাইটানিক ছিল হারল্যান্ড অ্যান্ড উলফ শিপইয়ার্ডে নির্মিত, যা বেলফাস্ট, আয়ারল্যান্ডে অবস্থিত। এর ডিজাইন এবং নির্মাণ ছিল একটি বিস্তৃত প্রকল্প, যা ১৯০৯ সালে শুরু হয় এবং ১৯১২ সালে সম্পন্ন হয়। টাইটানিক ছিল ৮৮২ ফুট ৯ ইঞ্চি (২৬৯.১ মিটার) লম্বা, ৯২ ফুট ৬ ইঞ্চি (২৮.২ মিটার) প্রশস্ত এবং ১৭৫ ফুট (৫৩.৩ মিটার) উচ্চ। এর ওজন ছিল প্রায় ৪৬,৩২৮ টন।
সুবিধা ও বিলাসিতা
টাইটানিকের নকশা এবং নির্মাণে বিলাসিতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এটি তিনটি শ্রেণির কেবিনে বিভক্ত ছিল:
1. **প্রথম শ্রেণি**: এখানে ছিল সুবিশাল ডাইনিং রুম, বিখ্যাত গ্র্যান্ড স্টেয়ারকেস, সুইমিং পুল, জিমন্যাসিয়াম, এবং বিলাসবহুল কেবিন।
2. **দ্বিতীয় শ্রেণি**: এখানে ছিল কমফোর্টেবল কেবিন, একটি সুন্দর ডাইনিং রুম এবং লাইব্রেরি।
3. **তৃতীয় শ্রেণি**: সাধারণত শ্রমিক এবং নিম্ন আয়ের যাত্রীরা এখানে অবস্থান করতেন, তবে কেবিনগুলি ছিল পরিষ্কার এবং স্বাস্থ্যকর।
প্রথম এবং শেষ যাত্রা
টাইটানিকের প্রথম এবং শেষ যাত্রা শুরু হয় ১০ এপ্রিল ১৯১২ সালে সাউদাম্পটন, ইংল্যান্ড থেকে নিউ ইয়র্ক সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে। জাহাজটি ফ্রান্সের শেরবার্গ এবং আয়ারল্যান্ডের কুইনস্টাউনে (বর্তমানে কোব) কিছু যাত্রী তুলে নিয়ে রওনা দেয়।
সংঘর্ষ ও ডুবে যাওয়া
১৪ এপ্রিল ১৯১২, রাত ১১:৪০ টায়, টাইটানিক একটি বিশাল আইসবার্গের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষের ফলে জাহাজের ডান পাশে কয়েকটি কম্পার্টমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পানি ঢুকতে শুরু করে। সংঘর্ষের প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে, ১৫ এপ্রিল ১৯১২, রাত ২:২০ মিনিটে, টাইটানিক সম্পূর্ণভাবে ডুবে যায়।
উদ্ধারকাজ ও পরিণতি
ডুবে যাওয়ার সময় জাহাজে প্রায় ২,২২৪ জন যাত্রী এবং ক্রু ছিল। এই দুর্ঘটনায় প্রায় ১,৫০০ জন প্রাণ হারান। লাইফবোটের সংখ্যা পর্যাপ্ত না হওয়ায় অনেকেই জাহাজের সাথে ডুবে যান। পরবর্তীতে আরএমএস কারপাথিয়া জাহাজটি টাইটানিকের বেঁচে থাকা যাত্রীদের উদ্ধার করে নিউইয়র্কে নিয়ে আসে।
ঐতিহাসিক প্রভাব
টাইটানিকের দুর্ঘটনা সামুদ্রিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে ১৯১৪ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সমুদ্র নিরাপত্তা সম্মেলন (SOLAS) অনুষ্ঠিত হয়, যা সামুদ্রিক যাত্রীবাহী জাহাজের জন্য নতুন নিরাপত্তা মানদণ্ড প্রবর্তন করে।